জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাব কেবল একটি গানের পরিবর্তন নয়, এটি আমাদের জাতীয় পরিচয়, ইতিহাস এবং স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থকে পরিবর্তনের প্রয়াস। ”বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী সংবিধানের সঙ্গে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবি জানান। এরপরই শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। ইতিপূর্বে তিনবার জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করার জন্য সরকারি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির পদে বসে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের জন্য কমিটি গঠন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. দ্বীন মুহাম্মদকে চেয়ারম্যান করে গঠিত ওই কমিটি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’, ফররুখ আহমদের ‘পাঞ্জেরি’ কবিতাকে জাতীয় সঙ্গীত করতে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ‘১৯৭৯ সালের ৩০ এপ্রিলে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ‘আমার সোনার বাংলা’কে বাদ দিয়ে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটিকে জাতীয় সংগীত করতে প্রস্তাব করা হয়েছিল। ক্যু পাল্টা ক্যুতে ওই প্রস্তাবের হালে আর পানি পড়েনি। ওইসময়ে একটা পাল্টা ক্যুতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় সেসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হয়নি। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের তৃতীয় দফার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল চারদলের জোট সরকারের আমলে। ২০০২ সালের ১৯ মার্চ তখনকার দুই মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনে যৌথ সুপারিশপত্র প্রধামন্ত্রীর কাছে জমা দেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া প্রস্তাবটি পরে আমলে নেননি।
বাংলাদেশ আমাদের অহংকার, বাংলাদেশ আমাদের কাছে ভালোবাসার আরেক নাম। বাংলাদেশ আমাদের আত্মপরিচয়। বাংলার ইতিহাস, বাংলার প্রকৃতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, মুক্তিসংগ্রাম আর ভাষার প্রতি ভালোবাসা৷ বাংলার মাটি- মানুষের মাঝে অপূর্ব মেলবন্ধন সৃষ্টিকারী আমাদের জাতীয় সংগীতের স্বকীয়তা আর শ্রেষ্ঠত্বের আশাতেই এ লেখার প্রয়াস পেয়েছি। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়গ্রাহী গান, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি”। আমরা দুর্ভাগ্যক্রমে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে নতুন করে নিজেদের জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হচ্ছি, শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সন্দিহান হচ্ছি, যে জাতীয় সংগীত স্বাধীনতা যুদ্ধে তার নিরন্তর আত্মত্যাগের স্মারক, যার কাঁধে রয়েছে এক সাগর রক্তের ঋণ।
প্রতিটি মানুষের নিজস্ব মতপ্রকাশের অধিকার আছে। যাকে আমরা বাকস্বাধীনতা বলে থাকি। কিন্তু একজনের মতের সাথে অন্যজনের দ্বিমত থাকাটা স্বাভাবিক। আমরা যখন সমাজ বা রাস্ট্রীয় বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করি, তখন আমার আমাদের মতামত সার্বজনীন না হলে বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মেনে না নিলে, সে মত বাস্তবায়ন হবেনা। রাস্ট্রে যদি স্বৈরতন্ত্র চলে, তাহলে ভিন্ন কথা। ইতিহাস সাক্ষী কোনো স্বৈরশাসকের স্থায়িত্ব নেই। সময়ের ব্যবধানে পতন অনিবার্য। আমাদের নিকট অতীত তাই বলে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগন যদি জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পক্ষে রায় দেয়, তাহলে জাতীয় সংগীত পরিবর্তন হোক। কিন্তু কোনো গোষ্ঠী যদি জাতীয় সংগীতকে গায়ের জোরে পরিবর্তন করতে চান, তাহলে আপনাদেরকেও ইতিহাস স্বৈরাচার হিসেবে চিন্তিত করবে।
যারা নানারকম অপব্যাখ্যা দিয়ে জাতীয় সংগীতকে বাদ দিতে চান, তাদের উদ্দেশ্য নিন্মলিখিত কয়েকটি জিজ্ঞাসা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ভারতে জন্মেছেন। আমাদের জাতীয় পতাকার নকশা তৈরি করেছেন, সদ্য প্রয়াত শিব নারায়ণ দাশ, তিনি ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয় গ্রন্থে সর্বপ্রথম স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের অন্তর্ভুক্ত করেন। বাংলা ভাষার পূর্বপুরুষ হচ্ছে, প্রোটো-গৌড়, যা এসেছিল প্রোটো-গৌড়-কামরূপ ভাষা থেকে, সেটি আবার এসেছিল প্রত্ন-মাগধী ভাষা বা মাগধী প্রাকৃত থেকে। বাংলা সাত দিনের নাম, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দেবতাদের নামে। বাংলা বারো মাসের নামকরণ হয়েছে, হিন্দু চন্দ্র ক্যালেন্ডার থেকে। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবে ভারত ও পাকিস্তানের অংশ ছিল। আমরা যারা বাংলাদেশি মুসলিম, ক্ষেত্রবিশেষ বাদে আমাদের পূর্বপুরুষরা ভারতীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিল। আপনারা কি এইসবও পরিবর্তন করবেন?
সময়োপযোগী সংস্কার বা পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। কিন্তু ইতিহাস- ঐতিহ্য বাদ দিয়ে নয়। ইতিহাস, ঐতিহ্যকে বাদ দিলে একটা জাতির অস্তিত বিলীনের সম্মুখীন হতে পারে। জাতীয় সংগীত নিয়ে জাতি আজ বিভক্ত। আমাদের মনো রাখতে হবে, একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি-ই পারে, দেশকে সমৃদ্ধির চুড়ান্ত শিখরে পৌঁছে দিতে। ২০২৪ সালের আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমাদের সেই সম্ভবনা তৈরি হয়েছে, এই সম্ভবনাকে ধূলিসাৎ না করে, আসুন আমরা সম্মিলিতভাবে দেশকে সমৃদ্ধির শিখরে পৌঁছে দেই।
কোটা সংস্কার দিয়ে শুরু করা রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে পতন হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের। গঠিত হয়েছে অন্তবর্তিকালীন সরকার। আমাদের উচিত গত ৫৩ বছরের জঞ্জাল পরিস্কারের জন্য সরকারকে সহযোগিতা করা। গত ৫৩ বছর ধরে দেশে চলছে ক্যু পাল্টা ক্যু, দলীয়করণ, দুর্নীতি, অন্যায়, হত্যা, নিপীড়ন, প্রতিহিংসা, বৈষম্য, আর্থিক কেলেঙ্কারি এবং অর্থ পাচারের মতো ঘটনা অহরহ। আমাদের উচিত দেশের জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য সরকারকে সহযোগিতা করা। জনসাধারণের বাকস্বাধীনতা, ভোটার অধিকার, মানুষের সকল গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনা, দুর্নীতিমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত, চাঁদাবাজমুক্ত দেশ গঠনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহযোগিতা করা, এটাই আমাদের মূল হওয়া লক্ষ্য হওয়া উচিত।
লেখক: শাহজাহান সিরাজ সবুজ- কবি, কলামিস্ট ও সাংবাদিক।