হাফেজ মাওলানা মোঃ সিরাজুল ইসলাম ও হাজী মোঃ জাকির হোসেন: এইতো চলে এলো হজ্ব। নির্ধারিত সময়ে আল্লাহর জন্য নবিজীর দেখানো পথে কাবা শরিফ তাওয়ায়, সাফা-মারওয়া সায়ী, আরাফা-মুজদালেফায় অবস্থান, মিনায় কংকর নিক্ষেপসহ কুরবানি ও মাথা মুন্ডন করার মতো নির্ধারিত কাজ সম্পাদন করার নামই তো হজ্ব। কোরআন সুন্নায় হজ্বের গুরুত্ব ও ফজিলত অনেক বর্ণিত হয়েছে।তার থেকে সামান্য কিছু গুরুত্ব ও ফজিলত উম্মতের ফায়দার জন্য পেশ করলাম।
হজ্ব কী?
হজ্ব মহান আল্লাহর নির্দেশ এবং একটি ইবাদত। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম হজ্ব। যাহা আর্থিক শারিরিক ইবাদত বলে গন্য ।আরবি হজ্ব শব্দের অর্থ সংকল্প করা বা ইচ্ছা করা। কোরআনুল কারিমে ১০২ বার হজ্ব শব্দটি উল্লেখ রয়েছে। তাই আল্লাহ তাআলা আর্থিক ও শারীরিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক ব্যক্তিকে পরিপূর্ণভাবে হজ্ব সম্পাদন করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ ফরজ হজ্বের উদ্দেশ্য হলো মহান আল্লাহর তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করা। আল্লাহ তাআলা হজ্বের নির্দেশ দিয়ে বলেন-
اَلۡحَجُّ اَشۡهُرٌ مَّعۡلُوۡمٰتٌ ۚ فَمَنۡ فَرَضَ فِیۡهِنَّ الۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَ لَا فُسُوۡقَ ۙ وَ لَا جِدَالَ فِی الۡحَجِّ ؕ وَ مَا تَفۡعَلُوۡا مِنۡ خَیۡرٍ یَّعۡلَمۡهُ اللّٰهُ ؕ وَ تَزَوَّدُوۡا فَاِنَّ خَیۡرَ الزَّادِ التَّقۡوٰی ۫ وَ اتَّقُوۡنِ یٰۤاُولِی الۡاَلۡبَابِ
অর্থ:-
‘হজ্বের সময় নির্দিষ্ট মাসসমূহ। অতএব এই মাসসমূহে যে নিজের উপর হজ্ব আরোপ করে নিল, তার জন্য হজ্বে অশ্লীল ও পাপ কাজ এবং ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়। আর তোমরা ভাল কাজের যা কর, আল্লাহ তা জানেন এবং পাথেয় গ্রহণ কর। নিশ্চয় উত্তম পাথেয় তাকওয়া। আর হে বিবেক সম্পন্নগণ, তোমরা আমাকে ভয় কর।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৯৭)
নির্ধারিত কয়েকদিন সুনির্দিষ্ট কিছু কাজ সম্পাদন করেই জান্নাত যাওয়ার ইবাদতের নাম হজ্ব। যাবতীয় পাপ থেকে নিষ্পাপ শিশুর মতো হওয়ার মাধ্যমও হজ্ব।
মনে রাখতে হবে হজ্ব ফরজ হওয়ার জন্য জমানো টাকা হওয়া শর্ত না । হজ্ব ফরজ হয় প্রত্যেক এমন ব্যক্তির উপর যার কাছে হজ্বের মৌসুমে (অর্থাৎ সাওয়াল, জিলক্বদ , ও জিলহাজ্ব মাসে) নিত্য প্রয়োজন ওপরিবার পরিজনের ভরন পোষন ও হজ্বের সফর শেষে ফিরে আশা পর্যন্ত পারিবারিক খরচ থেকে অতিরিক্তএই পরিমান সম্পদের মালিক হয় যার মাধ্যমে সে হজ্বের সফর করতে সক্ষম।তার উপরই হজ্ব ফরজ।
হাদিসের একাধিক বর্ণনায় এসেছে-
১. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য হজ্ব করলো এবং স্ত্রী সহবাস, যাবতীয় অশ্লীল কাজ ও গালমন্দ থেকে বিরত থাকলো; সে ওই দিনের মতো (নিষ্পাপ) হয়ে ফিরলো; যেদিন তার মা তাকে জন্ম দিয়েছিলো।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)
২. নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘হে আমর! তুমি কি জানো না যে, ইসলাম তার আগের সব গুনাহ নষ্ট করে দেয়? হিজরত তার আগের সব গুনাহ ধ্বংস করে দেয়? আর হজ্ব তার আগের সব গুনাহ মোচন করে দেয়?’ (মুসলিম, মিশকাত,)
৩. হজ্ব শুধু গুনাহ মোচনের উপায়ই নয় বরং হজ্বের বিনিময় শুধু জান্নাত। হাদিসে পাকে এসেছে-
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘এক ওমরাহ থেকে আরেক ওমরার মধ্যবর্তী সময়ের ছগিরা গুনাহসমূহের কাফফারা স্বরূপ। আর মাবরূর (কবুল) হজ্বের বিনিময় জান্নাত ছাড়া কিছুই নয়।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)
৪. হজ্ব ও ওমরা গুনাহ দূর করা এবং জান্নাত দেওয়ার পাশাপাশি দুনিয়ায় মানুষের দারিদ্রতাও দূর করে দেয়।
মনে রাখতে হবে
হজ্ব প্রতিটি মানুষের জন্য খুবই গুরুত্ব ও ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। কারণ নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক সাহাবির জিজ্ঞাসাবাদে সর্বোত্তম তিনটি বিশেষ কাজের মধ্যে হজ্বের কথাও বলেছিলেন। বিষয়টি হাদিসে এভাবে এসেছে-
৫. হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, সর্বোত্তম কাজ কোনটি? জবাবে তিনি বলেছিলেন, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। এরপর কী? তিনি বলেছিলেন, আল্লাহর পথে জিহাদ করা। এরপর কী? তিনি বলেছিলেন, মাবরূর হজ্ব।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিৎ, আল্লাহর জন্য নবিজীর দেখানো নিয়েম হজ্ব পালনের মাধ্যমে গুনাহ ও দারিদ্রমুক্ত জীবন পাওয়ার চেষ্টা করা। নিষ্পাপ হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করে পরকালে সুনিশ্চিত জান্নাতের অধিকারী হওয়া।তাই এই হজ্ব করার আগে আমাদের জেনে হবে হজ্বে ফরজ কয়টি ওয়াজিব কয়টি ও কিকি জিনিস নবীজী (স:) এর সুন্নত। এই বিষয় গুলো
ধারাবাহিক ভাবে বর্ণনা করা হলো :-
হজ্বের ফরজ সমূহ : হজ্বের ফরজ ৩টি যথা :
ক। ইহ্রাম বাঁধা তথা ইহ্রাম অবস্থায় হওয়া ।
খ। ৯ যিল্হজ্ব তারিখে সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কিছুক্ষণ সময়ের জন্য হলেও আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা। শরীয়ত সম্মত ওজর সাপেক্ষে ১০যিলহজ্বের সুবহে সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে কিছুক্ষণ অবস্থান করলেও ফরজ উকূফ আদায় হয়ে যাবে ।
গ। ১০, ১১ অথবা ১২ যিলহজ্ব তারিখের সূর্যাস্তের পূর্বেই কা’বা শরীফ তওয়াফ করা । এ তওয়াফকে ‘তওয়াফে যিয়ারত’ বলে । এটি হজ্বের ৩নং ফরজ আ’মল ।
উল্লেখিত ৩ টি ফরজের মধ্যে ১ টি ফরজ কাজও ইচ্ছায়/অনিচ্ছায় আদায় না করলে/ছুটে গেলে বা বাদ পড়ে গেলে হজ্ব হবে না । সেক্ষেত্রে পরবর্তী বছরে তাঁর জন্য হজ্বের কাযা আদায় করা ফরয হয়ে যাবে ।
হজ্বের ওয়াজিবসমূহ : হজ্বের প্রধান ওয়াজিব ৬ টি যথা : ক। ৯ যিলহজ্ব তারিখের দিনগত রাত্রের সুবহে সাদিক থেকে
সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত মুযদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব ।
খ। নির্ধারিত দিনে অর্থাৎ ১০, ১১, ১২/১৩ যিল্হজ্ব তারিখে মীনায় ৩ টি জামারাতে (ছোট, মেঝো ও বড়) মোট ৪৯ টি/৭০ টি পাথর নিক্ষেপ করা।
গ। কিরান ও তামাত্তু হাজীদের জন্য দমে শোকর আদায় করা অর্থাৎ কুরবানী করা । এটি হজ্বের কুরবানী, এটি ঈদের কুরবানী নয়।
ঘ। ইহরাম মুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে পুরুষের জন্য মাথা মুন্ডন করা অথবা মাথার সম্পূর্ণ চুল ছোট করে ছাঁটা এবং মহিলাদের জন্য সম্পূর্ণ চুলের অগ্রভাগ থেকে অর্থাৎ নিচের দিক থেকে ১ ইঞ্চি পরিমাণ কেটে ফেলা ।
সাফা ও মারওয়া পাহাড় দুটির মধ্যবর্তী স্থানে ৭ বার সায়ী করা।
চ। মক্কার বাইরের হাজীদের জন্য মক্কা ত্যাগ করার প্রাক্কালে বিদায়ী তওয়াফ করা।
উপরে উল্লেখিত ওয়াজিব সমূহ হতে যদি ১ টি ওয়াজিবও ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ছুটে যায়, তাতেও হজ্ব হয়ে যাবে। অবশ্য এক্ষেত্রে এক রা একাধিক ছুটে যাওয়া ওয়াজিবের জন্য দম দেওয়া (পশু জবাই করা) ওয়াজিব হবে।
(২) উপরোক্ত ওয়াজিব ছাড়াও হজ্বের বিভিন্ন আমল পালনের মাঝে আরো কিছু ওয়াজিব রয়েছে। সেগুলো এখানে উল্লেখ করলামঃ
ক) মীকাত অতিক্রম করার পূর্বেই ইহরাম বাঁধা।
খ) আরাফায় সূর্যাস্তের পরেও সামান্য কিছু সময় অবস্থান করা এবং হজ্বের ইমামের পূর্বে আরাফা ত্যাগ না করা।
গ) মুযদালিফায় পৌঁছে মাগরিব ও এশার নামাজ এশার ওয়াক্ত হওয়ার পর আদায় করা। তামাত্তু ও বিরান হজ্ব পালনকারীর জন্য হজ্বের কুরবানীর পূর্বেই রমী (পাথর নিক্ষেপ করা) করা। চুল কাটার পূর্বেই কুরবানী করা ।কোন ওযর না থাকলে পায়ে হেঁটে তওয়াফ ও সায়ী করা । হাজরে আসওয়াদের কোণা থেকে তওয়াফ শুরু করা এবং সেখানে ছ)এসে শেষ করা । জ) সাফা পাহাড় থেকে সায়ী শুরু করা এবং সায়ীর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।
৮। হজ্বের সুন্নাতসমূহ :
ক। মীকাতের বাহির থেকে আগত ইফ্রাদ হজ্ব পালনকারীগণ মক্কায় পৌঁছেই রমল ও ইজতিবাসহ তওয়াফে কুদুম করা ।
খ। কিরান হজ্ব পালনকারী উমরাহ্ শেষ করে মাথার চুল না কাটা এবং হজ্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ কুরবানী না করা পর্যন্ত ইহরামেই থাকা ।
গ। সাফা মারওয়া সায়ী করার সময় সবুজ লাইট দ্বারা চিহ্নিত দুই পিলারের মধ্যবর্তী স্থানটুকু পুরুষের জন্য ধীর গতিতে দৌঁড়ে অতিক্রম করা।
ঘ। ৮ যিল্হজ্ব মক্কায় ফজরের নামাজ আদায় করে মীনার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া এবং মীনার তাঁবুতে বা মসজিদে খায়েফে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা (অর্থাৎ ৮ যিলহজ্বের যোহর থেকে ৯ যিলহজ্বের ফজর পর্যন্ত)। বর্তমানে হাজীর সংখ্যা অত্যাধিক বৃদ্ধি পাওয়াতে এ নিয়ম অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। তাতে কোন অসুবিধা নেই অর্থাৎ এজন্য গুনাহ্ হবে না ।
ঙ। ৯ যিলহজ্ব সূর্যোদয়ের পর মীনা হতে আরাফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া। বর্তমানে সকলের জন্য এ নিয়ম অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। এতেও গুনাহ্ হবে না। কারন মুয়াল্লিমগণ ৮ যিলহজ্ তারিখের রাত থেকেই হাজীদেরকে আরাফাতে নিয়ে যান।
চ। ৯ যিলহজ্ব সূর্যাস্তের পর আরাফায় মাগরিবের নামাজ আদায় না করে মুযদালিফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়া ।
ছ। মুযদালিফায় সুবহে সাদিক পর্যন্ত অবস্থান করা ।
জ । আরাফার ময়দানে গোসল করা, তবে খুব বেশী পানির অপচয় না করা ।
শরীয়ত সম্মত ওজর ব্যতীত ৮ যিল্হজ্ব তারিখে এবং ১০ থেকে ১২/১৩ যিল্হজ্ব পর্যন্ত মীনার তাঁবুতে অবস্থান করা ।
উপরোক্ত সুন্নাত সমূহ থেকে কোন সুন্নাত স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেয়া ঠিক নয় । অবশ্য কোন সুন্নাত ছেড়ে দেয়ার জন্য সদাকা/কাফ্ফারা ওয়াজিব হবে না । তবে সুন্নাত পালনের সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হবেন । আল্লাহ আমাদের সবাইকে হজ্বের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নাত গুলো সঠিক ভাবে পালন করে হজ্ব করার তৌফিক দান করুন।