শৈশবে শোনা একটি গল্প দিয়েই লেখাটি শুরু করছি। এক রাজা’র এক বানর ছিলো। সে বানর প্রতিদিন রাজাকে একটি করে সোনার মহর এনে দিতো। রাজা সে মহর নিয়ে বানরকে জোরে লাঠি দিয়ে মারতো। বানর মার খেয়ে এক কোনায় গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতো। একদিন রাজা’র এক অতিথি দেখলো সোনার মহর এনে দেওয়া সত্ত্বেও রাজা বানরটিকে লাঠি দিয়ে মারে। সেটা দেখে রাজাকে অতিথি বললেন, আপনিতো খুব খারাপ। বানরটি আপনাকে সোনার মহর এনে দিলো আর আপনি তাকে মারলেন। রাজা বললেন, আমি কি কারণে বানরটিকে মেরেছি, তা আগামীকাল থেকে দেখতে পাবেন। কাল বানরটি যথারীতি একটি সোনার মহর এনে দিলো কিন্তু রাজা বানরকে মারলো না। তা দেখে বানরটি এক লাফে রাজা’র কোলে উঠে বসলো। তার পরের দিন আবার একটি মহর এনে দিলো, রাজা তাকে মারলো না। এবার বানরটি লাফ মেরে রাজা’র কাঁধে উঠে বসলো। তাতে রাজা’র অতিথি কিছু মনে করলো না। তার পরের দিন বানরটি একটি মহর এনে দিয়েই লাফ মেরে রাজা’র মাথায় উঠে রাজা’র কান টানা শুরু করে দিলো। তা দেখে রাজা’র অতিথি নিজেই বানরকে মারতে গেলো। এই হলো বানরদের স্বভাব। পৃথিবীর সকল দেশের সরকারের স্বভাব হলো, অনেকটা বানরের মতো। সুযোগ পেলেই স্বৈরাচার হয়ে উঠে। বিগত ১৬ বছরে আমাদের দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় শেখ হাসিনা সরকার ভয়ঙ্কর স্বৈরশাসকে পরিণত হয়েছিল। দেশে গুম, খুন, গণহত্যা, সীমাহীন লুটপাট, দুর্নীতির রাজত্ব কায়েম করেছিল। দেশে শক্তিশালী বিরোধী দলের অনুপস্থিতি শেখ হাসিনা ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের বেপরোয়া করে তুলেছিল। সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত হতে বাধ্য করার জন্য দেশে শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দল থাকা জরুরি। তা নাহলে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকেনা, সরকার আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একতরফাভাবে যা খুশি করে বেড়ায়। যার প্রমাণ শেখ হাসিনা সরকার। অতএব আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার যদি চাপে না থাকে, তাহলে অন্তর্বর্তী সরকার স্বৈরশাসকে পরিণত হবে না, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে আমাদের সমন্বয়করা সরকারকে ভালোই চাপে রেখেছে। এতে করে সরকারের স্বৈরাচার হওয়ার আপাতত কোনো সুযোগ থাকছে না। তবে সরকারকে নতজানু ধরনের সরকার হলেও চলবে না। দেশের সামগ্রিক স্বার্থে প্রয়োজনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ ছাত্র- জনতা নতুন বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব তাঁদের কাঁধে তুলে দিয়েছে।
আমাদের দেশে একটা আইন হওয়া জরুরি। যাঁরা সরকারের মন্ত্রী পরিষদে থাকবে, তাঁরা তাঁদের রাজনৈতিক দল থেকে মন্ত্রী থাকাকালীন সময় পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হবে। এতে করে দলটি সরকারের প্রভাবমুক্ত থাকবে, স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাতে পারবে এবং সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করতে পারবে। একই ব্যক্তি একই সাথে মন্ত্রী এবং দলের শীর্ষ নেতা থাকলে সরকারের সাথে সাথে দলকে ডুবায়। যার প্রমাণ আওয়ামিলীগ। আমাদের দুর্ভাগ্য আওয়ামিলীগের শীর্ষ নেতারাও সরকারের দুষ্কর্ম্মের সঙ্গী হয়েছিল। আর হবেই তো, তাঁরা একই সাথে দলীয় শীর্ষ নেতা এবং মন্ত্রী। শেখ হাসিনা সরকার ও আওয়ামিলীগের শীর্ষ নেতারা যেভাবে দেশটাকে বাপদাদার সম্পত্তি বানিয়েছিল, এতে করে ছাত্র- জনতার পাশাপাশি অসংখ্য, অগণিত আওয়ামী সমর্থক, আওয়ামীপন্থী লোকজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র- জনতার আন্দোলনে রাজপথে লড়াই করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকার বিরোধী প্রপাগাণ্ডা চালিয়েছেন। আমাদের সারজিস আলম একসময় ছাত্রলীগ করতেন। হাসনাত আবদুল্লাহ একসময় বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ছিলেন। অবশেষে তাঁরাই আওয়ামী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং সফল হয়েছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের পেছনে কোনো রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক শক্তি নেই। তাই বিপদে পড়লে সরকারকে রক্ষার জন্য সুসংগঠিত কোনো রাজনৈতিক শক্তি এগিয়ে আসবে না। বাকি রইলো জনসমর্থন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে। ইতিমধ্যে এই জনসমর্থনে কিঞ্চিৎ ভাটা পড়তে শুরু করেছে। জনসমর্থন হলো জোয়ার- ভাটার মতো, সরকার ভালো কাজ করলে জিন্দাবাদ, খারাপ কাজ করলে মুর্দাবাদ। আর এটাই স্বাভাবিক। জনতা ভালো কাজ করার জন্য সরকার বানায়, মন্দ কাজ করার জন্য নয়। জনগণ আশা করছে, অন্তর্বর্তী সরকার এমনভাবে রাস্ট্র সংস্কার বা মেরামত করে যাবেন, যাতে ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় এসে বিপথে পরিচালিত হতে না পারে। তা নাহলে ছাত্র- জনতার আত্মত্যাগ আত্মবলিদানের মধ্যে দিয়ে গঠিত সরকারও ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের চারপাশে যেসকল রাজনৈতিক শক্তি ঘুরঘুর করছে, নানাভাবে সরকারের পক্ষে কথা বলছে, এটা তাঁদের রাজনৈতিক স্বার্থেই কথা বলছে। তাঁরা এমুহূর্তে সরকারের বিরাগভাজন হতে চান না। তাছাড়া দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁদের অনুকূলে নেই। তাই তাঁরা পরিস্থিতি বিবেচনায় চুপ করে আছে। শীঘ্রই তাঁরাও খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। যখন তাঁরা মনে করবে, সরকারের দ্বারা তাঁদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল হবেনা। তখন একমুহূর্তে তাঁরাই সরকারের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করবে, রাজপথে নামবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো রাতারাতি এতো ভালো হলো কিভাবে, কোন মন্ত্র বলে। নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বুঝা রাজনৈতিক দলগুলো চরিত্র। এখন পর্যন্ত আমাদের দেশের সত্যিকারে কোনো দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক শক্তি সৃষ্টি হয়নি। আওয়ামিলীগ ফ্যাসিবাদী, এটা প্রমাণিত। বাদবাকিরা দুধে ধুয়া তুলসীপাতা নয়।
গত ৫৩ বছরে আওয়ামীলীগ সহ একাধিক রাজনৈতিক দলের শাসন দেখেছি। জাতীয় পার্টির দালালি দেখেছি। শেখ হাসিনা সরকার স্বৈরশাসকে পরিণত হওয়ার পেছনে জাতীয় পার্টির ভূমিকা বিশাল। জাতীয় পার্টি শেখ হাসিনা সরকারকে লাগাতার সমর্থন না দিলে শেখ হাসিনা স্বৈরশাসকে পরিণত হওয়ার সুযোগই পেতো না। জাতীয় পার্টি গাছের-টাও খেয়েছে, তলের-টাও খেয়েছে। একই সাথে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে। আবার শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী সভায় কয়েকজন মন্ত্রীও ছিলো জাতীয় পার্টির। আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের মধ্যে আওয়ামীলীগ বাদে বাদবাকিদের একজন ইউপি মেম্বার হওয়ার যোগ্যতা নেই। তাই তাঁরা লোভে পড়ে আওয়ামীলীগের দুষ্কর্ম্মের সঙ্গী হয়ে ফাঁন্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে অবস্থা। এর বাইরে একাধিক রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগকে সঙ্গ দিয়েছে। এদের অবস্থা একই। তবে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় একাধিক রাজনৈতিক সঙ্গীকে পাছায় লাত্থি মেরেছে। নির্বাচন করতে বাধ্য করেছে কিন্তু কোনো আসনে ছাড় দেয়নি। আওয়ামীলীগ ফেরারি, আওয়ামীলীগের সঙ্গী-সাথী বাদবাকি রাজনৈতিক দলসমূহ এখন গুহাবাসী। অবস্থাদৃষ্টে তাই মনে হচ্ছে। হয়তো একেই রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব বলে।
জুলাইয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনটি গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেওয়ার পেছনে আমজনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর বিশাল ভূমিকা ছিল। বিশেষকরে বিএনপি- জামায়াত যদি এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করতো, তাহলে এই আন্দোলন কখনোই সফলতার মুখ দেখতো না। তবে সম্মুখভাগের যুদ্ধা ছাত্ররাই ছিল, এটা আমাদের বিনাবাক্যে মানতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র- জনতার সফল গণ-অভ্যুত্থানের পরে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠে। অবশেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবির মুখে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এখন ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। ছাত্রলীগের অতীতের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে পদদলিত করে বিগত ১৬ বছরে যারা ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরা ছাত্রলীগকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে, যার পরিণতিতে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হয়েছে। এটা তাদের প্রাপ্য ছিল। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্রলীগ পুনরায় ফিরে আসতে পারবে কি-না, সেটা ভবিষ্যতের উপর ছেড়ে দিলাম। এব্যাপারে কোনো ভবিতব্য করতে চাই না। তবে রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কিছু নেই। যেখানে আওয়ামিলীগের কোনো দৃশ্যমান অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে ছাত্রলীগ আলোচনা করার তেমন কিছু নেই। তবে আলোচনা করতে গেলে অনেক অপ্রাসঙ্গিক বিষয় আলোচনায় চলে আসে।
আমি এবং আমার পরিবারের কোনো সদস্যই কখনোই আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম না। এমনকি আওয়ামীলীগ করার চিন্তাভাবনাও মাথায় আসেনি। কিন্তু বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান, মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী (জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী), জাতীয় চার নেতা সহ বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে যত মানুষের অবদান রয়েছে, তাঁদের সবাইকে শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি। যদি আমাকে প্রশ্ন করা হয়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নাম কি, তাহলে আমি নিঃসংকোচে, নির্দ্বিধায় বলবো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উনার সমান কেউ আছে বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করিনা। তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, মনছুর আলী বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে তাঁদের অবদান অপরিসীম। তাঁহারা বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি রেখেই ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার গঠন করেছিলেন। শেখ হাসিনা সরকার ও আওয়ামীলীগ জাতীয় চার নেতার পরিবারের সদস্যদের এমপি- মন্ত্রী বানিয়েছে এবং আওয়ামী রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করেছে, এটাও সত্য। কিন্তু জাতীয় চার নেতাসহ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অন্যান্য যেসকল মহান মানুষদের অবদান রয়েছে, তা আড়াল করেছে শেখ হাসিনা সরকার ও আওয়ামীলীগ। আওয়ামীলীগ বঙ্গবন্ধুকে জাতীয় সম্পদ থেকে আওয়ামী সম্পদে পরিণত করেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামীলীগকে বঙ্গবন্ধুর চরম অবমাননা প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু একটি বটবৃক্ষ। একটি বটবৃক্ষের সবকটি ডাল সতেজ থাকেনা, কিছু ডাল শুকনোও থাকে। দিনশেষে বটবৃক্ষ ক্লান্ত পথিককে ছায়া দেয়। বঙ্গবন্ধুর ভুলত্রুটি থাকতে পারে, কারণ উনি মানুষ। আর মানুষের ভুল হতেই পারে। কোনো মানুষের ভুলত্রুটি ধরার আগে পরিবেশ, পরিস্থিতি বিবেচনায় আনতে হবে। একজন নেতা সরকারে থাকলে বা রাস্ট্রের দায়িত্বে থাকলে পরিবেশ, পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সঠিক মনে না-ও হতে পারে। বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের অনেক বিষয়ে আমার ঘোরতর দ্বিমত আছে। কিন্তু বাহাত্তরের আগের বঙ্গবন্ধুকে নিঃসংকোচে, নির্দ্বিধায় স্যালুট জানাই। বঙ্গবন্ধুকে আমাদের দু’ভাবে বিবেচনা করতে হবে। বাহাত্তরের আগের সময়টা একভাবে আর বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত আরেকভাবে। তবে বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা উচিত নয়। বঙ্গবন্ধুকে দলীয়করণ ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে গিয়েই শেখ হাসিনা সরকার ও আওয়ামীলীগ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জাতির মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে।
লেখার এপর্যায়ে আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি। আপনারা জানেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা নামে একটি খনিজ সম্পদে ভরপুর প্রদেশ রয়েছে। আপনারা এ-ও জানেন এই প্রদেশ একসময় রাশিয়ার ছিলো। যার আয়তন বাংলাদেশের চার গুণ। রাশিয়ার কাছে বরফে ঢাকা আলাস্কাকে বোঝা মনে হয়েছিল, ওইসময় আলাস্কার ব্যয়ভার বহন করার ক্ষমতা রাশিয়ার ছিলনা। তাই রাশিয়া আলাস্কাকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করে দেয়। তখনকার বাস্তবতায় এটাই রাশিয়ার কাছে সঠিক মনে হয়েছিল। এখন আলাস্কার খনিজ সম্পদ দেখে রাশিয়া কাঁদে। শুধু তাই নয়, এই আলাস্কার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা রাশিয়ার প্রায় কোল ঘেঁষে। যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। এই বাস্তব কাহিনির মাধ্যমে আমি এটা বুঝাতে চেয়েছি যে, আজকের বাস্তবতায় যা কিছু সঠিক মনে হয়, ভবিষ্যতের বাস্তবতায় তা বেঠিক মনে হতে পারে। তাই কোনোকিছু সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে, ওই সময়ের পরিস্থিতি আগে জানা জরুরি। আমাদের সমন্বয়ক থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হয়ে উঠা নাহিদ ও নাফিস কি আগের মতোই জনপ্রিয় আছেন? নিঃসন্দেহে না। কারণ রাস্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিত থাকলে জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়বেই। রাস্ট্রীয় দায়িত্বে নিয়োজিত থাকলে সকলের মন জুগিয়ে চলা যায়না, রাস্ট্রের সার্বিক ভালো হবে, সেই বিবেচনায় কাজ করতে হয়। তাই বলে কি আমরা নাহিদ ও নাফিসের আগের অবদান ভুলে যাবো। কোনো মানুষের বর্তমান ভুলত্রুটির জন্য অতীতের মহান কাজগুলো অস্বীকার বা অসম্মান করা উচিত নয়। বঙ্গবন্ধুর ভুল থাকতে পারে বা আছে। সেটা নিয়ে আমরা চুল-ছেঁড়া বিশ্লেষণ করতেই পারি। কিন্তু তাঁকে অসম্মান কিংবা তাঁর অবদানকে অস্বীকার করা কি উচিত? ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর কিছু সম্মানিত মানুষের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার ও অসম্মান করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যেনো বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করা। এই কাজটি আওয়ামীলীগ অত্যন্ত নিকৃষ্টভাবে করেছে। এদেশের জনসাধারণ আওয়ামীলীগের প্রতিচ্ছবি আর কোনো দল এবং ব্যক্তির মধ্যে দেখতে চায়না।
শেখ হাসিনা সরকার ও আওয়ামীলীগ বঙ্গবন্ধুকে দলীয়করণ করেছে, বঙ্গবন্ধুকে অপব্যবহার করেছে, বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখেছে, নবী-রাসুলের পর্যায়ে নিয়ে গেছে এর দায়তো বঙ্গবন্ধুর নয়। এদায় আওয়ামিলীগ ও শেখ হাসিনা সরকারের। আমরা যদি আমাদের অতীতের মহান নেতাদের অবদানকে অস্বীকার করার সংস্কৃতি সৃষ্টি করি, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদেরকে তখনকার প্রজন্ম অস্বীকার করবে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমাদের প্রতিহিংসার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদেরকে শ্রদ্ধা, স্নেহ ও ভালোবাসার সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে হবে, তাহলে নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি হবে। তাহলেই আমাদের জুলাই- আগস্টের আত্মত্যাগ, আত্মবলিদান স্বার্থক হবে।
২০১২ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার মধ্যে মোটামুটি গণতান্ত্রিক মনোভাব ও আচরণ দেখেছি। আমার এই কথায় অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে। ২০১৩ সালের পর থেকে শেখ হাসিনার আচরণ পাল্টে যেতে থাকে। কতিপয় আমলা, প্রশাসনিক কর্মকর্তার প্ররোচনা এবং তেলবাজদের চক্রান্তের কারণে শেখ হাসিনার যে মানসিক বিবর্তন ঘটে, সেখানে তাঁকে নিয়ে বা তাঁর পরিবার নিয়ে কেউ টু শব্দ উচ্চারণ করলে, তিনি সমালোচনাকারীকে শায়েস্তা করার জন্য পাগল হয়ে যেতেন এবং শায়েস্তা না করা পর্যন্ত শান্ত হতেন না। ড. মুহাম্মদ ইউনুস আমাদের স্বপ্ন- ভালবাসা- ঘাম- শ্রম- রক্তের ফসল। তাঁকে নিয়ে যাতে কোনো আমলা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং তেলবাজরা গেইম খেলতে না পারে, সেদিকে সমন্বয়ক ও অন্যান্য উপদেষ্টাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। পাশাপাশি দেশবাসীকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
ইতিমধ্যে ডিসি নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতির খবরে সারাদেশে তোলপাড় হয়েছে। মব জাস্টিস নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছে, হচ্ছে। গণহারে মামলা, নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা, নিয়োগ বা চাকরি থেকে বাদ দেওয়া, আদালত প্রাঙ্গনে আসামীর উপর হামলা এইসব খবরে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় কম হয়নি। সর্বশেষ আদালত প্রাঙ্গনে কতিপয় আইনজীবী একজন আসামীর আইনজীবীকে হেনস্তা করলো। অপরাধ করলে শাস্তি পাবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একজন আসামীর আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে। সেটা সে নিজেও করতে পারে অথবা আইনজীবীর মাধ্যমে করতে পারে। আর একজন মানুষের অপরাধ যতক্ষণ পর্যন্ত প্রমাণিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে অপরাধী বলা যাবেনা। দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে, এজাতীয় ঘটনা নতুন করে ঘটতে দেওয়া উচিত নয়। এজাতীয় ঘটনা ঘটতে থাকলে, শেখ হাসিনার চেয়েও জঘন্য ফ্যাসিবাদ তৈরি হয়ে যেতে পারে। অতএব নতুন বাংলাদেশ গড়তে হলে সবাইকে দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে। অন্যথায় যেই লাউ, সেই কদু।
লেখক: শাহজাহান সিরাজ সবুজ, সহযোগী সম্পাদক- দৈনিক গণমানুষের আওয়াজ।