বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি প্রবাদবাক্য ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে। প্রবাদবাক্যটি হলো, যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবণ। আমরা লঙ্কাপতি রাবণকে দেখি নাই। কিন্তু বাংলাপতি রাবণদের দেখা-সাক্ষাৎ বহুবার পেয়েছি। বাংলাপতি রাবণদের সাতকাহন আজকের লেখায় উল্লেখ করবো না। বাংলাপতি রাবণদের কাহিনি ছেলে-বুড়ো সবারই জানা। বাংলাদেশের মানুষ আর কোনো বাংলাপতি রাবণকে দেখতে চায়না। তাই ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি মানুষের সীমাহীন প্রত্যাশা। জনসাধারণের এই প্রত্যাশা পূরণে সরকার কতটা আন্তরিক, তা সময় বলে দিবে। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুস- এর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনআকাঙক্ষা পূরণে কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তা তাদের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ঘোষণার পরেই বুঝা যাবে। তবে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক চাপ সামলে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনাও চাট্টিখানি কথা নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি জনসাধারণের আস্থার জায়গাটা সুবিশাল। কিন্তু জনমনে একটা ক্ষীণ আশঙ্কাও কাজ করছে, আর তা হলো জিয়া ও এরশাদ ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। ড. মুহাম্মদ ইউনুস ক্ষমতা দখল করে নাই। উনাকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে বা রাস্ট্র সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যেভাবেই বলি, তিনিও এখন রাস্ট্রীয় ক্ষমতায়। তিনিও কি শেষপর্যন্ত সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদের পথেই হাঁটবেন? যদিও এমনটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যকলাপে লক্ষণীয় নয়।
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের আগে বাংলাদেশে রাস্ট্র সংস্কারের কোনো আন্দোলন হয়নি। এটাই প্রথম রাস্ট্র সংস্কারের আন্দোলন। তবে বাংলাদেশের দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সংস্কারের আন্দোলন করেছিল দল দু’টির কিছু প্রভাবশালী নেতা। তখন যদি দল দুটিতে সংস্কার হতো, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ তৈরি হতো। কিন্তু সেই সংস্কার আন্দোলন হালে পানি পায়নি। জাতি এবার রাস্ট্র সংস্কার চায়। এ সংস্কার একটু-আধটু ঘষামাজা করে ছেড়ে দিলেই হবেনা। একটু-আধটু পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন করে, নতুন একটা রঙ চটচটে রূপ দিলেই হবেনা, বাহারি কিছু কথামালা সংযোজন করলেই হবেনা। এমন সংস্কার হতে হবে, যে সংস্কারের মাধ্যমে রাস্ট্রের আমূল পরিবর্তন হবে, দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে। এমন সংস্কার হতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো স্বৈর শাসক সৃষ্টি হতে না পারে। দুর্নীতি করার সাহস না পায়। তবে রাস্ট্র সংস্কার করাটা মোটেও সহজ কাজ নয়। কারণ গত ৫৩ বছরের বাংলাপতি রাবণদের পেতাত্মারা কমবেশি সরকারি সব প্রতিষ্ঠানেই বিরাজমান। এরা যে নীরবে-নিভৃতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। পরিস্থিতির চাপে তারা এখন ঘাপটি বসে থাকলেও সুযোগ পেলেই পূর্বের রূপ ধারণ করবে, ফণী তুলে ছোবল দিবে।
তত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া নয়। দেশ শেষপর্যন্ত রাজনৈতিক সরকারের হাতেই যাবে। এটাই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। কিন্তু আমাদের দেশে সত্যিকারের কোনো দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল না থাকায় জনসাধারণ চাইছে, ড. মুহাম্মদ ইউনুস- এর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনতে, দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করুক। দেশের জনসাধারণ আশা করছে রাস্ট্রীয় সংস্কারের কাজ ক্রমেই দৃশ্যমান হবে। রাস্ট্রীয় সংস্কারের কাজ যদি দৃশ্যমান না হয়, তাহলে জনগণ অচিরেই আস্থা হারারে। দেশে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রক্ষমতা একসময় রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণেই যাবে। কিন্তু তার আগেই রাস্ট্র সংস্কার জরুরি।
বাংলাদেশে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল না থাকায় এদেশের মানুষ বারবার আওয়ামিলীগ ও বিএনপি’র প্রতি ভরসা রেখেছে।আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি দীর্ঘসময় রাস্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল। এই তিনটি দলের মূল চালিকাশক্তি হলো পরিবারতন্ত্র। এই তিনটি দলের কোথাও কোনো গণতন্ত্র চর্চা নেই। অন্যান্য গতানুগতিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও পরিবারতন্ত্র ও ব্যক্তিতন্ত্রের আধিক্য ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। এদিকে জামাত বাদে বাদবাকি দলগুলোর তেমন একটা গণভিত্তি নেই। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জামাতের গণবিরোধী কার্যকলাপের কারণে জামাতের প্রতি দেশের জনসাধারণের একটা বিশাল অংশ আস্থা রাখতে পারছেনা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জামাতের রাজনৈতিক বক্তব্যগুলো খুবই গঠনমূলক। আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি রাস্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালীন জনগণের সেবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেনি। নিজেদের শোষকে ভূমিকায় অবতীর্ণ করেছিলেন। তাই তারা এখন যতই মিষ্টি বলুক, জনগণ তাদের প্রতি আস্থা রাখতে ভয় পায়। বাংলাদেশের জনগণের দূর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও এদেশে কোনো প্রকৃত দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেনি। আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হয়, কায়েমি স্বার্থবাদীরা কোনো রাজনৈতিক দল গড়ে উঠতে দেয়নি। দেশে এমুহূর্তে কোনো রাজনৈতিক দল গঠিত হয়ে, দেশের সামগ্রিক পরিবর্তনে অতীন্দ্রিয় ভূমিকা পালন করবে, সেই সম্ভবনাও লক্ষণীয় নয়।
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতিত সরকারের অবস্থা বিবেচনা করে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর শিক্ষা নেওয়া উচিত। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দলকে ভেতর থেকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের সংস্কার করতে না পারলে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সকল সংস্কারমূলক কাজকর্ম অর্থহীন হয়ে পড়বে। তারা ক্ষমতায় এসে পূর্বের রূপ ধারণ করবে। অতএব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সংস্কার ও গণতন্ত্র চর্চা জরুরি। নিকট অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ক্ষমতা প্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা করে, নিজেদের সংশোধন করে, তাহলেই তাদের মঙ্গল, দেশেরও মঙ্গল। অন্যথায় প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গড়ে তোলা ছাড়া নাগরিকদের সামনে বিকল্প কোনো পথ খোলা থাকবেনা। দেশের জনসাধারণ আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দেশের সকল প্রকার বৈষম্যের অবসানে এবং জনসাধারণের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে নিজেদের আত্মনিয়োগ করবে।
ক্ষমতা প্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলো স্বরণ করিয়ে দিতে চাই। শেখ হাসিনার সরকার টানা সাড়ে ১৫ বছর মানুষের মগজে আওয়ামীলীগ আর বঙ্গবন্ধুকে ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য এমন কোনো কাজ নেই, যা করে নাই। জোরকরে মানুষের মগজে কোনো কিছু ঢুকানো যায়না। যদি জোরকরে মানুষের মগজ ধোলাই করা যেতো, তাহলে শেখ হাসিনার সরকারের এমন করুণ পরিণত হতো কি? শৌচাগার থেকে শুরু করে এমন কোনো জায়গা নেই, যা দলীয়করণ করে নাই। এসব না করে যদি তারা গণতন্ত্র চর্চা করতো, তাহলে তাদের এমন পরিণতি হতো না।
শেখ হাসিনা তার শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছর ধরে সার্বজনীন জাতীয় দিবস গুলোকে পর্যন্ত দলীয়করণ করেছে। এর বাইরে ১৫ আগস্ট শোক দিবস, শেখ মুজিবের জন্ম দিবস, শেখ রাসেল দিবস, বেগম ফজিলাতুন্নেসা দিবস, বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফুটবল টুর্নামেন্ট, মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারি তৈরি, বঙ্গবন্ধু কর্নার, শেখ রাসেল কর্নার ইত্যাদি। এখানেই শেষ নয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সড়ক, মহাসড়কের নামকরণের ক্ষেত্রে দলীয়করণ হয়েছে একতরফা। বিগত সময়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্থাপনার নাম পরিবর্তন করার ক্ষেত্রেও সিদ্ধহস্ত ছিল শেখ হাসিনার সরকার। শেখ হাসিনার শেখানো পথেই হাঁটছে এবার জনগণ। নানারকম আওয়ামী দিবস পালনের মধ্যদিয়ে মানুষের মগজধোলাই, বিশেষকরে তরুন প্রজন্মের মগজধোলাই করার জন্য এমন কোনো চেষ্টা নেই, যা করে নাই। শুক্রবার, সরকারি ছুটি, স্কুল-কলেজ খোলা থাকা অবস্থায়, এমনকি ধর্মীয় দিবসের সময়েও আওয়ামী দিবসগুলো মানুষের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা- কর্মচারী থেকে শিক্ষকরা পর্যন্ত মনে করতো স্কুল, কলেজে অনুপস্থিত থাকলেও তার চাকরি যাবেনা কিন্তু এসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত না থাকলে তার চাকরি চলে যেতে পারে। ঘর থেকে বের হলেই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য, সবকিছুতেই বঙ্গবন্ধু, দেশটা যেনো বঙ্গবন্ধুময়। এসব করেই বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে আওয়ামিলীগ। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, টানা সাড়ে ১৫ বছর যাবত্ দেশটাকে বঙ্গবন্ধুময় ও আওয়ামীকরণ করেও এই জেনারেশনের কেউ আওয়ামীলীগ হলো না। ক্ষমতা প্রত্যাশী রাজনৈতিক দলগুলো যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেয়, তাহলে তাদের পরিণতি ভবিষ্যতে শেখ হাসিনা ও আওয়ামীলীগের মতোই হবে।
গণ-অভ্যুত্থানের সুফল বহুমাত্রিক, বহুমুখী হবে, এটাই স্বাভাবিক। সুফল সবাই ভোগ করবে, সবার ঘরে যাবে, এটাও স্বাভাবিক। ইতিমধ্যে বিএনপি, জামাত সুফল ভোগ করা শুরু করেছে। এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদ রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পেয়েছে। গণসংহতি আন্দোলন নিবন্ধন পাওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে। অবশ্য এই দলগুলোর গণ-অভ্যুত্থানে ব্যাপক ভূমিকা ছিল, আত্মত্যাগ, আ’ত্মহুতিও ছিল। তাই তাদের সুফল পাওয়ার অধিকারও আছে। সমন্বয়কদের দু’জন উপদেষ্টা হয়েছে। একজন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হয়েছে। সমন্বয়কদের দুজন উপদেষ্টা এবং একজন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হওয়ায় মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। আমরা যারা কলম সৈনিক, গণ-অভ্যুত্থানে আমাদেরও বিশাল ভূমিকা ছিল। আমাদেরও ছিল আত্মত্যাগ, আ’ত্মহুতি। আমরা কলম সৈনিকরা মন্ত্রী, এমপি হতে চাইনা। আমরা চাই, আমাদের কলমের স্বাধীনতা। আমরা আমাদের কলমের স্বাধীনতা পাবো কিনা, এখনো নিশ্চিত নই। ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ, আত্মহুতির বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবেনা। ছাত্র-জনতা চায় বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। এদিকে দুজন প্রধান সমন্বয়ক, যারা এখনো রাজপথে আছে, তাদের বিরুদ্ধে ত্রাণের টাকা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। কমবেশি জল ঘোলাও হচ্ছে। তাহলে কি একথাই সত্য “যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবণ”। পরিশেষে বলতে চাই, “যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবণ” অন্তত এবার এই প্রবাদবাক্যটি অসত্য প্রমাণিত হোক।
লেখক: শাহজাহান সিরাজ সবুজ-
কবি, কলামিস্ট, সাংবাদিক।