রাষ্ট্র কেন ব্যর্থ হয়? প্রশ্নটি দারুণ এবং বিশ্ব জুড়ে এর ব্যাপকভাবে সমাদৃত উত্তর খুঁজে বের করেছেন ড্যারন একেমোগলো এবং জেমস এ রবিনসন। বিশ্বের অন্যতম সেরা এই দুই সমাজবিজ্ঞানী ‘হোয়াই ন্যাশনস ফেইল’ শীর্ষক বইটিতে উল্লেখ করেছেন যে, ‘কোনো রাষ্ট্রের রাজনীতি যদি ঠিকঠাক না হয়, তাহলে রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিকশিত হয় না, বা কাজ করতে পারে না। আর এ কারণেই কার্যকর গণতন্ত্রের অভাব থাকলে কোনো রাষ্ট্র সেভাবে বিকশিত হতে পারে না।’
আমাদের দেশে ঠিক রাজনৈতিক কারণেই যে প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কাক্সিক্ষত মাত্রায় ভূমিকা রাখতে পারেনি তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ খুব কম। এখানে রাজনীতির অযাচিত হস্তক্ষেপ ক্রীড়াক্ষেত্র থেকে শুরু করে প্রশাসন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমনকি বিচার বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়েছে।
একটি দলীয় সরকার পতনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে কেন পদত্যাগ করতে হবে? সরকারের পতনের পর কেন প্রধান বিচারপতিসহ কিছু বিচারপতির পদত্যাগের দাবি উঠবে? বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের ভিসি আর প্রক্টরদের মধ্যে কেন পদত্যাগের হিড়িক পড়ে যাবে? তার মানে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে এরা সবাই রাজনৈতিক বিবেচনায় নিযুক্ত ছিলেন। একটা রাষ্ট্রের বিকাশে এর চেয়ে বড় বাধা আর কী হতে পারে?
ফলে, গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশার পাহাড় জমতে দেখছি। সেটা হওয়াও স্বাভাবিক। আমার কাছে মনে হয় নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে এই দেশে যে ‘ডেমোক্রেটিক ডেফিসিট’ বা গণতান্ত্রিক যে ঘাটতিগুলো আছে সেগুলো আগে ঠিকঠাক করে ফেলা দরকার। ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডেভিড মারকুয়ান্ড রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যথাযথ প্রতিনিধিত্বের অভাব, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব এবং গুটিকয়েকের কাছে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ থাকার একটি পরিস্থিতি বুঝাতে ডেমোক্রেটিক ডেফিসিট ধারণা তুলে ধরেছিলেন ১৯৭০-এর দিকে। বলাবাহুল্য এই দেশে ঘাটতিগুলো প্রকট থেকেছে সবসময়ই।
নতুন সরকারকে তাই সেই ঘাটতিগুলো পূরণ করতে হবে, এটাই সুযোগ। ঘাটতিগুলো পূরণের এবং বাংলাদেশকে একটি আধুনিক-উন্নত দেশে পরিণত করতে হলে সংস্কার প্রয়োজন বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের। সংবিধান, জাতীয় সংসদ, নির্বাচনব্যবস্থায় পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংশোধন প্রয়োজন, অবশ্যই। এই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবেও। এই নিবন্ধে এগুলোর বাইরে বাংলাদেশে গণতন্ত্র সুসংহত করতে এবং এর সুফল সবার কাছে সমানভাবে পৌঁছে দিতে ও সেটা টেকসই করতে গুটিকয়েক পরামর্শ মনে করিয়ে দিতে চাই।
আমাদের দেশে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ আর বিচার বিভাগের সম্পর্ক হয়ে গেছে এক এবং অদ্বিতীয়! ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলই এখানে সব নিয়ন্ত্রণ করে। অথচ মন্টেস্কু অনেক বছর আগেই এই তিনটি বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা ভাগের একটি ব্যবস্থার সুপারিশ করেছেন, যাতে এর কোনো বিভাগই নিরঙ্কুশ ক্ষমতা না পেয়ে যায়। ম্যাক্স ওয়েবার আবার বলেছেন নিরপেক্ষ, আইন-বিধি ভিত্তিক ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত আমলাতন্ত্রের কথা। জন স্টুয়ার্ট মিল গুরুত্ব দিয়েছেন সিভিল সার্ভিস বা সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের ওপর। এর বাইরে এসব প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্টদের মুক্ত থাকতে হবে কালচারাল হেজিমনি বা সরকারের ‘সাংস্কৃতিক অধিপত্যবাদ’ থেকে। এন্থোনিও গ্রামসি বলেছেন যে, অনেক সময় অনেক ক্ষমতাসীন দল সর্বক্ষেত্রে তার প্রতিষ্ঠিত ধারণা, মত, বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতেই সচেষ্ট হয়। সর্বক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সীমাহীন প্রচেষ্টা ছাড়া অন্য কোনো পরামর্শ আমাদের দেশে বাস্তবায়ন যে নেই তা স্পষ্ট। বেশ কঠিন, কিন্তু নতুন সরকারের কার্যতালিকায় এই বিষয়গুলো রাখা উচিত।
আমাদের সমস্যাগুলো কী আর সমাধানে কী করণীয় সেগুলো আসলে আমাদের সামনে আছে, অনেক দিন ধরেই। প্রয়োজন শুধু করণীয়টাকে কর্মসূচিতে রূপান্তরের। এই যেমন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারের সম্পর্ক। দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট অনেক বছর আগেই বলেছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সত্য এবং জ্ঞান অর্জনে সক্ষম করে তুলতে বাইরের অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে দূরে রাখতে হবে।
সরকার আর বিশ্ববিদ্যালগুলোর মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যার একটি বহুল প্রচারিত তথ্য বা মডেল হলো ‘ত্রিপল হেলিক্স মডেল’। হেনরি ইটসকুইজ এবং লেয়েট লেইডেসডরফ এই মডেল দাঁড় করিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়, সরকার এবং শিল্পের সঙ্গে সহযোগিতামূলক এবং পরস্পর নির্ভরশীলতার একটি সম্পর্কের কথা বলেন। এই মডেল অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু শিক্ষাই প্রদান করার জন্য নয়, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সৃজনশীল অবদান রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে কাজ করবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করবে, কিন্তু নিজের স্বকীয়তা এবং স্বাধীনতা বজায় রেখেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কাজে লাগাতে হবে দেশের প্রয়োজনে উদ্ভাবনী গবেষণায়, দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিতে নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের কথা ধরা যাক। বিগত সরকারের অনেক উন্নয়নই ঢাকা পড়ে গেছে দুর্নীতি আর অর্থপাচারের ঘটনায়। লুটপাটে ব্যাংকব্যবস্থা প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক পুরোপুরি ব্যর্থ। এজন্য দায়ী ব্যাংকটিতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বা হস্তক্ষেপ। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা এবং একটি কার্যকর মুদ্রাব্যবস্থা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার বিকল্প নেই।
মিল্টন ফ্রিডম্যান এবং কেনেথ রোগোফ মুদ্রাস্ফীতি কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং মুদ্রানীতি সফলতার সঙ্গে ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে রাখার সুপারিশ করেছেন। উল্টোটা হলে, অর্থাৎ রাজনৈতিক প্রভাব থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ দেখতে বাধ্য হয়, তা দেশের জন্য অমঙ্গলজনক হলেও। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ফিন ই কিডল্যান্ড এবং ইডওয়ার্ড সি প্রেসকট কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাজনৈতিক প্রভাবের কুফল তুলে ধরেছেন। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত তাদের বিখ্যাত ‘রুলস র্যাদার দ্যান ডিসকারশন : দি ইনকসিসটেন্সি অব অপটিমাল প্ল্যানস’ প্রবন্ধে বহুল চর্চিত ‘টাইম ইনকনসিসটেন্সি’ তথ্য মনে হয় বাংলাদেশকে উদ্দেশ্য করেই তুলে ধরেছিলেন। সেখানে তারা বলেছিলেন, মুদ্রানীতিতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকলে সরকার তাৎক্ষণিক বা সাময়িক অর্থনৈতিক লক্ষ্য পূরণে নানা উদ্যোগ নেয়, যেমন টাকা ছাপানো ইত্যাদি। সাধারণত সরকারগুলো নির্বাচনের আগে কর্মসংস্থান বাড়ানো বা জনগণকে খুশি করার কিছু প্রকল্প নেওয়ার জন্য এই ধরনের উদ্যোগ নেয়। প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ উইলিয়াম নর্ডহাউস। তিনি তার পলিটিক্যাল বিজনেস থিওরিতে বলেছেন, এসব উদ্যোগ বা নীতি সাময়িক সময়ে কিছু সমস্যার সমাধান হয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সংকট আরও বাড়ায়। তৈরি হয় মুদ্রাস্ফীতির মতো সমস্যা। নতুন সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেন সবসময় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বাইরে থাকতে পারে সে ব্যাপারে কঠিন-কঠোর কিছু সংস্কার করতে হবে। তবে এই সংস্কারের সময় মনে রাখতে হবে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ চার্লস গুডহার্টের পরামর্শ, তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবশ্যই সরকারের প্রতি ও জনগণের প্রতি জবাবদিহি থাকতে হবে।
নতুন সরকারের উপদেষ্টাম-লী এই দেশ এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শ্বনামধন্য ও সুনামধারী। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারা ঈর্ষণীয়ভাবে উজ্জ্বল। সুতরাং পরামর্শ নয়, বলা যায় সাধারণ একজন নাগরিকের কিছু প্রত্যাশার কথা তুলে ধরলাম এই রচনায়। দীর্ঘদিনের জঞ্জাল অল্প সময়ে সাফ করা প্রায় অসম্ভব, এর জন্য নতুন সরকারের পর্যাপ্ত সময় প্রয়োজন। সেই সময়টুকু দিতে আমরা কি তৈরি?
লেখক: মো. মুজিবুল হক মনির, গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।