আমার বাংলাদেশ, হায়রে আমার অভাগা বাংলাদেশ। আর কত রক্ত ঝরবে তোর বুকে। আর কত রক্ত ঝরলে বন্ধ হবে পৈচাশিক উন্মাদনা? ‘মব জাস্টিস’ বাহ্যিক অবয়বে মানুষ হলেও মানবতার বিবেনায় আপনারা আদৌও কি মানুষ? আপনাদের পশুর সাথে তুলনা করলে, পশুও লজ্জিত হবে। সমগ্র জাতি আজ আপনাদের বিরুদ্ধে। তোফাজ্জলের নির্মম হত্যাকাণ্ড জাতিকে কাঁদিয়েছে অজোরে। জাতি লজ্জিত, জাতি ক্ষমা চাচ্ছে তোফাজ্জলের কাছে। মব জাস্টিস আপনারা কি লজ্জিত? গত ৫৩ বছর দেশটা ছিল মগের মুল্লুক। এখন দেশটা মব জাস্টিসদের মুল্লুক। উচ্ছৃঙ্খল জনতা, হুজুগে জনতা, ইতর জনতা, দাঙ্গাকারী জনতা, উত্তেজিত জনতাকে ভদ্দরলোকি ‘বাংলায়’ বলে ‘মব’। এই ‘মব’রা এখন ‘মব জাস্টিস’ এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। একদিনে তিনটি বিচার করলো ‘মব জাস্টিস’। ভোরে বগুড়ায়, বিকেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, একদিনে তিনটি লাশ পড়ে গেল। ‘মব জাস্টিস’ আসামি আটক করল, বিচারক হয়ে দণ্ড দিল এবং জল্লাদ হয়ে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করল।
বগুড়ার শেরপুরে গরুচোর সন্দেহে আসিফ প্রামাণিক (৪০) নামের এক ব্যক্তিকে মব পিটিয়ে মেরে ফেললেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক- শামীম আহমেদ বিকেলে জাবি ক্যাম্পাসের একটি দোকানে ছিলেন। ১৫ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগ ও বহিরাগত সন্ত্রাসীদের হামলায় তিনি যুক্ত ছিলেন, এই অভিযোগে একদল শিক্ষার্থী তাকে আটক করেন। অতপর কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী ‘মব’ হয়ে উঠেন। ‘মব’ তাৎক্ষণিকভাবে শামীমকে পিটিয়ে মেরে ফেললেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের একদল শিক্ষার্থী বুধবার সন্ধ্যার পর ‘মোবাইল চোর’ সন্দেহে তোফাজ্জল নামের এক মানসিক ভারসাম্যহীন এক তরুণকে ধরলেন। অতপর দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা মুহূর্তে ‘মব’ হয়ে উঠলেন। মোবাইল চোরকে পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য অপরাধী মনে করে তারা চোরের বিচারে ‘জাস্টিস’ চর্চা শুরু করলেন। চোরকে পিটিয়ে মেরে ফেললেন। বুধবারের (১৮ সেপ্টেম্বর) এই তিনটি ঘটনার বাইরেও গত একমাসের অধিক সময় যাবত্ মবের এই ধরনের বহু ‘জাস্টিস চর্চা’র ঘটেছে।
আমাদের পুলিশ বাহিনীকে বিগত সময়ে এতটাই অপব্যবহার করা হয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর পুলিশ বাহিনীর উপর দিয়ে একটা কালবৈশাখী ঝড় বয়ে গেছে। এই কালবৈশাখী ঝড়ের নাম ‘মব’। এই মব ঝড়ে প্রাণহানির ঘটনা কম নয়। মব ঝড়ে পর আমাদের পুলিশ বাহিনী আজও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এমতাবস্থায় পুলিশ বাহিনীর কাছে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে বলিষ্ঠ ভূমিকা আশা করা বোকামি। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পাওয়ার দিয়ে ৬০ দিনের জন্য মাঠে নামিয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী পদক্ষেপ। দেশের জনসাধারণ আশা করছে, এবার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আসবে। মব জাস্টিস নিপাত যাবে।
আমরা সবাই জানি ‘জাস্টিস’ কথাটার আক্ষরিক মানে ন্যায়বিচার। কিন্তু ‘মব জাস্টিস’ কথাটার মধ্যে জনসাধারণের একটা বড় অংশ একধরনের ন্যায্যতা খুঁজে পায়। তাই তারা এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডগুলোকে অপরাধমূলক হত্যাকাণ্ড বা খুন হিসেবে দেখল না। এর মধ্যে তারা ন্যায্যতা খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু আমাদের সবারই মনে রাখা উচিত, আমরা কেউ আইন হাতে তুলে নিতে পারিনা, আমরা কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নই। আদলত চত্বরে অনেকেই ‘মব জাস্টিস’ হয়ে উঠেন। কাউকে পঁচা ডিম মারা, কাউকে লাত্থি মারা, কাউকে থাপ্পড় মারা ইত্যাদি ঘটনা ঘটিয়েছে ‘মব জাস্টিস’। এইসব দেখে অনেকেই উল্লসিত হয়েছে। হয়তো তারা এটিকেই ‘উচিত সাজা’ মনে করেছেন। আজকের বিচার ব্যবস্থা আর বিগত সাড়ে ১৫ বছরের ব্যবস্থা এক নয়। দেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার প্রতি আমাদের আস্থা রাখতে হবে। ছাত্র- জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তবর্তিকালীন সরকারের প্রতি আমাদের আস্থা রাখতে হবে। সরকারের সফলতা অনেকাংশে আমাদের উপর নির্ভর করে। তাই সরকারকে সহযোগিতা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
‘মব’ এমনই ভয়ানক জিনিস। যদি আমরা ইতিহাসের চাকা পিছনের দিকে ঘুরাতে না চাই, গত ৫৩ বছরে পরিস্থিতিতে ফিরে যেতে না চাই। তাহলে সম্প্রতি যেসব মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর সাথে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব- কর্তব্যের মধ্যে পড়ে বলে দেশের সচেতন জনসাধারণ মনে করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি এইসব ঘটনা সমূহ আমলে না নেয়, দোষীদের আইনের আওতায় না আনে, তাহলে এই ‘মব জাস্টিস’ সারাদেশে সংক্রামক ব্যাধি হয়ে সমাজে ছড়িয়ে পড়তে পারে। মব জাস্টিস এবং আমাদের সকলের মনে রাখা উচিত, কেউ যদি সত্যি সত্যি গরুচোর, মোবাইল চোর কিংবা হামলাকারী আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাও হয়, তাহলে তাকেও পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়না। আইনত তো নয়ই, নৈতিক, ধর্মীয় কিংবা অন্য কোনো বিবেচনায়ই নয়। এখন প্রশাসনে অস্থিরতা আছে। বিশেষকরে পুলিশ শতভাগ সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। মব জাস্টিস ঘটনা সমূহের পর পুলিশ বাহিনী এখনো ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। নৈরাজ্যবাদী, নৈরাজ্যমনস্ক লোকেরা এসব ভালোভাবে জানে, তাই তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মব জাস্টিস সংক্রামক হয়ে ছড়িয়ে পড়ার আগেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে।
শেখ হাসিনার শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে সীমাহীন লুটপাট, দুর্নীতি, অর্থ পাচার, দলীয়করণ, আইনের শাসন না থাকা, সুবিচার না পাওয়া, অনিয়মের ঘটনাগুলো জনগণকে বিষিয়ে তুলেছিল। সবমিলিয়ে শেখ হাসিনার শাসনামলে রাষ্ট্র পরিচালনায় অনিয়মের ঘটনাগুলো জনগণকে বিক্ষুব্ধ করে। তবে মামলা-হামলার ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে পারছিল না। জনসাধারণ সব যন্ত্রণার বিস্ফোরণই হলো ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান। মব জাস্টিস, নৈরাজ্যবাদীদের উদ্দেশ্যে বলছি, অর্থ-বিত্ত, পেশিশক্তি, রাস্ট্রীয় ক্ষমতায় ভর করে আওয়ামিলীগের শীর্ষ নেতারা ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন, তারাও আওয়ামীলীগকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলে রেখে লাপাত্তা। প্রাণ বাঁচাতে দলের প্রধান হাসিনাও পালিয়ে ভারতের আশ্রয়ে। অনেকেই গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেন, কেউ অজেয় নয়, মব জাস্টিস আপনারাও অজেয় নন। বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, মব জাস্টিসদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। ভিডিও ফুটেজ দেখে এদেরকে আইনের আওতায় আনা খুব কঠিন কাজ নয়। জনতা ইতিমধ্যে মব জাস্টিসদের ধরে পুলিশে সোপর্দ করা শুরু করেছে। কেউ কেউ পুলিশের হাতে আটক হয়েছে।
একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর রক্তাক্ত আরেক অধ্যায়ের নাম চব্বিশের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান। ছাত্র- জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তবর্তিকালীন সরকারকে কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের কথা বাদ দিলে জনসাধারণের নিরঙ্কুশভাবে ড. মুহাম্মদ ইউনুস- এর নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন করে। মব জাস্টিস, নৈরাজ্যমনস্ক, নৈরাজ্যবাদীরা ষড়যন্ত্র করে সরকারকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করলে, ছাত্র- জনতা আপনাদের প্রতিহত করবে। অতএব সাধু সাবধান।
লেখক: শাহজাহান সিরাজ সবুজ- কবি, কলামিস্ট, সাংবাদিক।