বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছরে মানুষের বাকস্বাধীনতা ছিলনা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছিলনা, হয়েছে সীমাহীন লুটপাট, অর্থ পাচার, ক্ষমতার অপব্যবহার, ক্ষমতার দম্ভ, দলীয়করণ। গুম-খুন, মিথ্যা মামলা-হামলা, অপপ্রচার। এমনি কি কথায় কথায় মানুষের গায়ে ট্যাগ লাগানো হতো। অবশ্য ট্যাগ লাগানোর প্রবণতা এখনো ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। আমরা আমাদের বাকস্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, গণমাধ্যমে স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার সমূহ আদৌও ফিরে পাবো কিনা, তা সময় বলে দেবে। তবে দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখছে, এবার গণতান্ত্রিক অধিকার সমূহ ফিরে পাবে। অবশ্য সেই সম্ভবনাও তৈরি হয়েছে। আবার নানাকারণে মানুষের মনে অবিশ্বাসও কাজ করছে।
আমরা রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল করবো, এটা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের নামে শ্রমজীবি মানুষদের রাজনীতি বা রাজনৈতিক দল গঠন করার পথকে ব্যাপকভাবে বাঁধাগ্রস্ত করা হয়েছে বলে দেশের শ্রমজীবি মানুষেরা মনে করে। আমাদের দেশে কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত না হলে, সেই রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন পেতে হলে, যেসব শর্ত পূরণ করতে হয়, তা শ্রমজীবীদের পক্ষে অসম্ভব। যাতে শ্রমজীবি মানুষের নেতৃত্বে কোনো রাজনৈতিক দল গড়ে উঠতে না পারে, তাই বুর্জোয়া রাজনৈতিক শক্তির এতো আয়োজন। রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইনের মাধ্যমে শ্রমজীবি মানুষের রাজনৈতিক দল গঠন করার অধিকার বাঁধাগ্রস্ত হওয়ায় রাজনৈতিক নিবন্ধন আইন বাতিল হওয়া দরকার।
দেশে শ্রমজীবি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে বলে দাবিদার রাজনৈতিক দলগুলো কি আদৌও শ্রমজীবি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে? দৃশ্যতঃ আমরা এর কোনো প্রমাণ দেখতে পাচ্ছি না। তাই যাতে শ্রমজীবি মানুষ রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারে, তারজন্য রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইনটি বাতিল করা দরকার। এদিকে বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বে গড়ে উঠা রাজনৈতিক দলে কখনোই গণতন্ত্র চর্চা হয়না। এটা প্রমাণিত সত্য। অতএব এসব দলে শ্রমজীবি মানুষের মতামত দেওয়ার অধিকার থাকেনা বললেই চলে। যদিও মতামত দেয়, তা দিনশেষে মূল্যহীন। বরং এসব দলে শ্রমজীবি মানুষেরা উচ্ছিষ্ট হয়ে থাকে। শুধুমাত্র মিটিং, মিছিল, সমাবেশে নিজেদের ক্ষমতা বা শক্তি- সামর্থ্য প্রদর্শনে এদের দরকার হয়। এরপর যে-ই সে-ই।
আমাদের দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো তাদের শৌর্যবীর্য হারিয়ে কাগুজে বাঘে পরিণত হয়েছে। এদের এখন শ্রমজীবি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার মনোবল অবশিষ্ট আছে কিনা সন্দেহ আছে। এদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্ন সময়ে শাসকগোষ্ঠী বা শাসক দলের লেজুড়বৃত্তি করে বিভিন্ন সুযোগ- সুবিধা নিয়েছে। এমপি, মন্ত্রী হয়েছে। এদের কেউ কেউ বর্তমানে কারাগারে আছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে একাধিক দলের নেতারা জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়ায় তারা নিবন্ধন পেয়ে যায়। তাই তারা নিবন্ধন বাতিল করার বিষয়ে কখনোই সোচ্চার হয়নি। দেশের শ্রমজীবি মানুষেরা আশা করেছিল, বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এবিষয়ে সোচ্চার হবে। কিন্তু তারা নীরব ছিল। একই কারণে একাধিক ইসলামিক দল নিবন্ধন পেয়েছে। আবার একাধিক ইসলামিক দল শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হওয়ায় নিবন্ধন পেয়েছে। বর্তমান সময়েও একাধিক রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পেয়েছে। এবং আরো একটি রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পেতে পারে বলেও শোনা যাচ্ছে। এসব দলগুলো নিয়ে কথা বলার সময় এখনো আসেনি।
আমাদের দেশের বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো কার্ল মার্কস, এঙ্গেলস, লেলিন, স্ট্যালিন, মাও সেতুং এর আদর্শের কথা বলে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে। এরা সবাই সমাজতন্ত্রের কথা বললেও রণনীতি, রণকৌশলের নামে বহুভাগে বিভক্ত। এদের অনেকের মধ্যে সমাজতন্ত্রের আদর্শ চর্চা হয় কিনা সন্দেহ আছে। তাদের চলনে-বলনে তা দৃশ্যমান নয় বলে দেশের জনসাধারণ মনে করে। এদিকে আমাদের দেশের ইসলামিক দলগুলো কোরআনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার কথা বলে, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সঃ) কে নেতা মানেন। আমরা সবাই জানি এবং মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি কোরআনে কোনো ধরনের ভুল নেই। নবীজির আদর্শে কোনো ভুল নেই। সবাই যদি কোরআনের আইন বাস্তবায়ন করতে চায়, নবীজির আদর্শের আলোকে দেশ চালাতে চায়, তাহলে এরা বহুভাগে বিভক্ত কেনো?
বর্তমানে ইসলামিক দলগুলোর জয়জয়কার। এদের পক্ষে ব্যাপকভাবে জনমতও তৈরি হচ্ছে। কিন্তু একটি বিশেষ শ্রেণির লোকেরা যেভাবে ওলি-আউলিয়াদের মাজারে ভাঙচুর, হামলা করছে, এতে করে ইসলামিক দলগুলোর জনমতে ভাটা পড়তে পারে। মাজার জিয়ারত শরিয়ত বিরোধী নয়। মাজারে যাতে শরিয়ত বিরোধী কোনো কর্মকান্ড সংগঠিত না হতে পারে, তা আইন করে বন্ধ করা হোক। দেশের মানুষ ভাঙচুর, অশান্তিতে বিশ্বাসী নয়। দেশের মানুষ শান্তি চায়।
বর্তমানে দেশে চরম বিশৃঙ্খল পরিবেশ বিরাজমান। যার যা মন চাচ্ছে, সে তাই করছে। অবস্থাদৃষ্টে সরকারকে কিছুটা অসহায় মনে হচ্ছে। আমরা এতদিন আমাদের নানারকম স্বাধীনতার কথা বলেছি। আমার মনে হয়, বর্তমান সরকারকে আমাদের আরো স্বাধীনতা দেওয়া দরকার। তাহলেই ভালো কিছু হতে পারে। সরকারকে ভালো কিছু করার জন্য চাপে রাখা দোষের কিছু নয়। কিন্তু পাশে যদি ছায়া সরকার থাকে বা অদৃশ্য ছড়ি ঘুরতে থাকে, তাহলে প্রত্যাশিত ফল না-ও পেতে পারি।
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর হইতে দেশে একের-পর-এক বিশৃঙ্খলা লেগেই আছে। কিছু অতিউৎসাহী মানুষ নানারকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। আবার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বুঝে না বুঝে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। আমরা যদি এভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে থাকি, তাহলে এই বিশৃঙ্খল পরিবেশের সূত্র ধরে আন্তর্জাতিক অপশক্তি আমাদের দেশে অনুপ্রবেশের সুযোগ পাবে। এমনিতেই আমাদের দেশের উপর আন্তর্জাতিক অপশক্তির বদনজর পড়ে আছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে সবাই দেশ গড়ার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সহযোগিতা করা উচিত।
২০২৪ সালের আশাজাগানিয়া গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে কি আমরা ভয়মুক্ত? আমরা কি ভয়মুক্ত ভাবে মতামত ব্যক্ত করতে পারছি? লিখছি বটে, তবে ভয়ে ভয়ে। আমরা কি আদৌও বাকস্বাধীনতা ফিরে পেয়েছি? এটা সময় বলে দিবে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মানুষের স্বপ্ন পূরণ করবে, মানুষ এমনটাই বিশ্বাস করে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও তা-ই স্বপ্ন দেখি।
লেখক: শাহজাহান সিরাজ সবুজ- কবি, কলামিষ্ট, সাংবাদিক।